ইতিহাস Flashcards
সূর্যাস্ত আইন কাকে বলে
সূর্যাস্ত আইন ছিল ব্রিটিশ আমলে প্রবর্তিত একটি রাজস্ব আইন। এই আইন অনুসারে, জমিদারদের নির্দিষ্ট দিনে সূর্যাস্তের আগে তাদের জমির রাজস্ব সরকারি কোষাগারে জমা দিতে হত। যদি কোনো জমিদার এই সময়ের মধ্যে রাজস্ব জমা দিতে ব্যর্থ হতেন, তবে তাদের জমি নিলামে বিক্রি করে দেওয়া হত।
এই আইনটি ১৭৯৩ সালে লর্ড কর্নওয়ালিসের প্রবর্তিত চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের একটি অংশ ছিল। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল রাজস্ব আদায় নিশ্চিত করা এবং জমিদারদের মধ্যে নিয়মিত কর পরিশোধের অভ্যাস তৈরি করা।
সূর্যাস্ত আইনের প্রভাবে অনেক জমিদার তাদের জমিদারি হারিয়েছিলেন, কারণ তারা নির্দিষ্ট সময়ে রাজস্ব পরিশোধ করতে পারতেন না। এর ফলে ভূমি মালিকানার ক্ষেত্রে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে এবং অনেক নতুন জমিদার শ্রেণির উত্থান ঘটে। এই আইন একদিকে যেমন ব্রিটিশ সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুদৃঢ় করেছিল, তেমনি অন্যদিকে অনেক পুরনো জমিদার পরিবারকে অর্থনৈতিক সংকটের মুখে ফেলেছিল।
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত কী
রায়তওয়ারি বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতে প্রচলিত একটি ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায় সরকার সরাসরি রায়ত বা কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো:
* সরাসরি বন্দোবস্ত: এই ব্যবস্থায় জমির মালিকানা কৃষকদের হাতে ন্যস্ত করা হয় এবং সরকার সরাসরি তাদের সঙ্গে রাজস্বের বন্দোবস্ত করে। জমিদার বা মধ্যস্বত্বভোগীদের কোনো ভূমিকা ছিল না।
* জমির স্বত্ব: রায়ত বা কৃষকদের জমির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। তারা জমি বিক্রি, বন্ধক রাখা বা উত্তরাধিকার সূত্রে হস্তান্তরের অধিকার লাভ করে।
* রাজস্বের হার: জমির উর্বরতা ও ফসলের প্রকারভেদের ওপর ভিত্তি করে রাজস্বের হার নির্ধারণ করা হতো। তবে এই হার প্রায়শই বেশি ছিল এবং সরকারের ইচ্ছানুসারে তা পরিবর্তনের সুযোগ থাকত। কোথাও কোথাও মোট উৎপাদনের ৫০-৬০ শতাংশ পর্যন্ত রাজস্ব ধার্য করা হতো।
* वार्षिक বন্দোবস্ত: প্রতি বছর জমির জরিপ করা হতো এবং সেই অনুযায়ী রাজস্ব নির্ধারণ করা হতো। এর ফলে কৃষকদের ওপর অনিশ্চয়তা বজায় থাকত।
* ব্যক্তিগত দায়: প্রত্যেক কৃষক তার জমির জন্য ব্যক্তিগতভাবে রাজস্ব পরিশোধ করতে দায়বদ্ধ ছিল। রাজস্ব দিতে ব্যর্থ হলে তাদের জমি বাজেয়াপ্ত করার অধিকার সরকারের ছিল।
এই ব্যবস্থা মূলত মাদ্রাজ (বর্তমান চেন্নাই), বোম্বাই (বর্তমান মুম্বাই) এবং দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশে চালু ছিল। থমাস মুনরো এই ব্যবস্থার প্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত কী
মহলওয়ারি বন্দোবস্ত ছিল ব্রিটিশ ভারতে প্রচলিত একটি রাজস্ব আদায় ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থায়, গ্রাম বা কয়েকটি গ্রামের সমষ্টিকে ‘মহল’ হিসেবে গণ্য করা হত এবং এই মহলের প্রধান বা কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তি সরকারের কাছে রাজস্ব জমা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ থাকতেন। নিচে এই বন্দোবস্তের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক আলোচনা করা হলো:
* প্রবর্তন: ১৮২২ সালে হোল্ট Mackenzie এই ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। পরে লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক ১৮৩৩ সালে এর কিছু সংস্কার করেন।
* এলাকা: উত্তর-পশ্চিম প্রদেশ (অধুনা উত্তর প্রদেশ), আগ্রা, আওধ, মধ্যপ্রদেশ এবং পাঞ্জাবের কিছু অংশে এই ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল।
* রাজস্ব নির্ধারণ: জমির উৎপাদন ক্ষমতা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে রাজস্ব নির্ধারণ করা হত। এটি স্থায়ী বন্দোবস্তের মতো নির্দিষ্ট ছিল না এবং সময়ে সময়ে এর পরিবর্তন ঘটানো হত।
* দায়িত্ব: গ্রামের প্রধান ব্যক্তি বা কয়েকজন মিলে রাজস্ব সংগ্রহের দায়িত্ব পালন করতেন এবং সরকারের কোষাগারে জমা দিতেন। জমির মালিকানা কৃষকদের হাতেই ছিল, কিন্তু রাজস্ব দেওয়ার দায়িত্ব সমষ্টিগতভাবে মহলের উপর ন্যস্ত ছিল।
* সুবিধা: এই ব্যবস্থায় গ্রামের মানুষজনের মধ্যে এক ধরনের সমষ্টিগত দায়িত্ববোধ তৈরি হয়েছিল।
* অসুবিধা: রাজস্বের হার অনেক সময় বেশি ধার্য করা হত, যার ফলে কৃষকদের উপর চাপ সৃষ্টি হত। এছাড়া, রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে গ্রামের প্রধানদের ক্ষমতা অনেক সময় স্বেচ্ছাচারী হতে পারত।
এই মহলওয়ারি বন্দোবস্ত একদিকে যেমন গ্রামীণ সমাজকে একত্রিত করার চেষ্টা করেছিল, তেমনই এর কিছু দুর্বলতাও ছিল যা কৃষকদের জন্য কষ্টের কারণ হত।
ভারতে কোম্পানি শাসন বিস্তারের প্রেক্ষিতে রেলপথ বানানোর উদ্দেশ্য কী ছিল
ভারতে কোম্পানি শাসনের বিস্তারকালে লর্ড ডালহৌসি রেলপথ নির্মাণের পিছনে বেশ কয়েকটি উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যগুলি প্রধানত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থ রক্ষা এবং তার বিস্তারকে সুগম করার দিকেই নিবদ্ধ ছিল। নিচে কয়েকটি প্রধান উদ্দেশ্য আলোচনা করা হলো:
* সামরিক ও কৌশলগত উদ্দেশ্য: ডালহৌসি মনে করতেন, রেলপথ দ্রুততার সাথে সৈন্য ও রসদ সরবরাহ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে বিদ্রোহ দেখা দিলে বা সীমান্ত এলাকায় দ্রুত সেনা মোতায়েন করতে রেলপথ অপরিহার্য ছিল।
* অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য: রেলপথের মাধ্যমে দেশের অভ্যন্তর থেকে কাঁচামাল (যেমন - তুলা, পাট, খনিজ দ্রব্য) দ্রুত বন্দরগুলিতে পৌঁছে দেওয়া যেত এবং সেখান থেকে উৎপাদিত পণ্য সহজে দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে আসা যেত। এর ফলে ব্রিটিশ বাণিজ্য আরও সুদৃঢ় হতো এবং কোম্পানির মুনাফা বৃদ্ধি পেত।
* প্রশাসনিক সুবিধা: বিশাল ভারতবর্ষের বিভিন্ন প্রান্তে শাসনকার্য পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ করা রেলপথ ছাড়া কঠিন ছিল। রেলপথের মাধ্যমে সরকারি আধিকারিকরা দ্রুত বিভিন্ন স্থানে যাতায়াত করতে পারতেন এবং প্রশাসনিক কাজকর্ম আরও efficient হত।
* রাজনৈতিক ঐক্য: ডালহৌসি বিশ্বাস করতেন, রেলপথ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলকে ভৌগোলিকভাবে সংযুক্ত করার পাশাপাশি রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনেও সাহায্য করবে।
* প্রাকৃতিক সম্পদের আহরণ: দেশের অভ্যন্তরে ছড়িয়ে থাকা খনিজ সম্পদ এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণ করে তা দ্রুত শিল্পাঞ্চলে পৌঁছে দেওয়ার জন্য রেলপথের প্রয়োজনীয়তা ছিল।
মোটকথা, লর্ড ডালহৌসির রেলপথ নির্মাণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক, সামরিক ও প্রশাসনিক স্বার্থকে আরও শক্তিশালী করা এবং ভারতের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও সুদৃঢ় করা। যদিও এর ফলস্বরূপ ভারতের যোগাযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছিল, তবে এর মূল চালিকাশক্তি ছিল ঔপনিবেশিক স্বার্থ।
ভারতে কোম্পানি শাসন বিস্তারের প্রেক্ষিতে টেলিগ্ৰাফ বানানোর কী উদ্দেশ্যে ছিল
ভারতে কোম্পানি শাসনের বিস্তারকালে লর্ড ডালহৌসি টেলিগ্ৰাফ ব্যবস্থা স্থাপনের পিছনে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য ছিল। এই উদ্দেশ্যগুলি ব্রিটিশদের শাসনকে আরও সুদৃঢ় ও কার্যকর করতে সাহায্য করেছিল। নিচে প্রধান উদ্দেশ্যগুলি আলোচনা করা হলো:
* দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন: কোম্পানির প্রশাসনিক কাজকর্ম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য দ্রুত যোগাযোগের একটি নির্ভরযোগ্য মাধ্যম অপরিহার্য ছিল। টেলিগ্ৰাফের মাধ্যমে সরকারি নির্দেশ, গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ এবং কর্মকর্তাদের মধ্যে দ্রুত যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল।
* সামরিক নিয়ন্ত্রণ: বিদ্রোহ বা অন্য কোনো আপৎকালীন পরিস্থিতিতে দ্রুত সেনা মোতায়েন এবং তাদের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য টেলিগ্ৰাফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। দূরবর্তী স্থানে অবস্থিত সৈন্যদের কাছে দ্রুত বার্তা পাঠানো এবং তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করা সহজ হয়েছিল।
* আইনশৃঙ্খলা রক্ষা: টেলিগ্ৰাফের মাধ্যমে দ্রুত খবর আদান-প্রদান করে অপরাধ দমন এবং আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখা যেত। কোনো স্থানে গোলযোগ সৃষ্টি হলে দ্রুত সেই খবর পৌঁছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হত।
* অর্থনৈতিক সুবিধা: বাণিজ্যিক কাজকর্মের দ্রুত পরিচালনার ক্ষেত্রে টেলিগ্ৰাফ সহায়ক ছিল। বাজারের তথ্য, পণ্যের দাম এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্যিক বার্তা দ্রুততার সাথে আদান-প্রদান করা যেত, যা কোম্পানির ব্যবসায়িক স্বার্থ রক্ষা করত।
* রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার: ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে ব্রিটিশ কর্তৃত্ব বজায় রাখা এবং স্থানীয় শাসকদের উপর নজরদারি করার জন্য টেলিগ্ৰাফ একটি শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে কাজ করত।
* প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি: টেলিগ্ৰাফের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সরকারের সাথে প্রাদেশিক প্রশাসনের যোগাযোগ আরও নিবিড় হয়, ফলে প্রশাসনিক কাজকর্মের দক্ষতা বৃদ্ধি পায়।
* আধুনিকতার প্রতীক: টেলিগ্ৰাফ স্থাপনকে ব্রিটিশ সরকার তাদের উন্নত প্রযুক্তি এবং আধুনিক চিন্তাভাবনার প্রতীক হিসেবে তুলে ধরেছিল, যা ভারতীয়দের মধ্যে তাদের ক্ষমতা ও শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা আরও বদ্ধমূল করতে সাহায্য করত।
মোটকথা, কোম্পানি শাসনের বিস্তারকালে টেলিগ্ৰাফ স্থাপন শুধুমাত্র একটি যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না, এটি ছিল ব্রিটিশদের রাজনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা সুসংহত করার একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। লর্ড ডালহৌসির এই উদ্যোগ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে আরও শক্তিশালী এবং দীর্ঘস্থায়ী করতে সহায়ক হয়েছিল।